জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি? বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষা ব্যবস্থা
আপনি যদি জানতে চান, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি? বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্যারিয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান,তাহলে আজকের এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে বিভিন্ন প্রযুক্তির সমন্বিত একটি রূপ। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিএনএ পরিবর্তন করার একটি প্রক্রিয়া হয়ে থাকে। একটি প্রাণির জিনগুলোই সেই প্রাণির সকল বৈশিষ্ট্য বহন করে থাকে। জীব দেহের ক্ষুদ্রতম একক হচ্ছে কোষ আর সেই কোষের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে নিউক্লিয়াস এবং নিউক্লিয়াসের ভিতরে থাকে ক্রোমোজোম আর এই ক্রোমোজোমের মধ্যে চেইনের মত প্যাঁচানো সেই বস্তুটিই হচ্ছে DNA। আবার এই DNA এর একটি নির্দিষ্ট অংশকে জিন বলা হয়ে থাকে, আর এই জিনগুলোই প্রাণি বা উদ্ভিদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে থাকে।
সুতরাং, প্রাণি বা উদ্ভিদের বিকাশ কীভাবে ঘটবে এবং তাদের আকৃতি কীরুপ হবে তা সংরক্ষিত থাকে প্রাণি বা উদ্ভিদ কোষের DNA সিকোয়েন্সে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় আমাদের কৃষি খাতে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রযুক্তির সুষ্ঠ ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা অনেকটা দূর করা সম্ভব হয়েছে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি?
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অপর নাম জেনেটিক মডিফিকেশন বা জেনেটিক ম্যানিপুলেশন।জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, যা বংশাণু প্রকৌশল নামেও পরিচিত, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হলো জীবের জিনগত গঠন পরিবর্তন করার একটি প্রযুক্তি। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিএনএ (ডিঅক্সিরিবোনিউক্লিক অ্যাসিড) নামক জৈব অণুতে পরিবর্তন এনে করা হয়ে থাকে, যা জীবের জিনগত তথ্য ধারণ করে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং জীবপ্রযুক্তির একটি অগ্রণী শাখায় উপনিত হয়েছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জীবের জিনগত গঠন পরিবর্তন করে নতুন বৈশিষ্ট্য প্রদানের ক্ষমতা ধারণ করে থাকে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি জীববিজ্ঞান, ঔষধ, কৃষি এবং পরিবেশ বিজ্ঞান সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জনক
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর একজন নির্দিষ্ট "জনক" নেই বরং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর অবদানের ফসল। তবে, কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব যাদের কাজ জিন প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ।
- ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার: ১৯৫৩ সালে ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার DNA-এর রাসায়নিক গঠন নির্ধারণ করেন।এই আবিষ্কার জিনগত তথ্য পড়া এবং বোঝার জন্য অপরিহার্য ছিল, যা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য ভিত্তি স্থাপন করে।
- পল বার্গ: ১৯৭২ সালে, পল বার্গ প্রথম "জিন স্প্লাইসিং" প্রদর্শন করেন, যেখানে DNA-এর নির্দিষ্ট অংশগুলি একটি জীব থেকে অন্য জীবে স্থানান্তরিত করা হয়। এই কৌশল জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীব তৈরির জন্য অপরিহার্য, যা চিকিৎসাগত চিকিৎসা উন্নত করতে এবং নতুন ওষুধ তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
- স্ট্যানলি কোহেন এবং হার্বার্ট বয়ার: ১৯৭৩ সালে, এই দুই বিজ্ঞানী প্রথম সফলভাবে জীবাণুর DNA কে পুনরায় সংমিশ্রিত করতে সক্ষম হন, যা "রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি" নামে পরিচিত। এই অগ্রগতি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভিত্তি স্থাপন করে।তাদের এই কাজ জীবের জিনগত কোড পরিবর্তন করার ক্ষমতা প্রদান করে, যার ফলে চিকিৎসা, কৃষি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে।
উল্লেখ্য যে, এছাড়াও আরও অনেক বিজ্ঞানী জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
- জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক: DNA এর গঠন আবিষ্কার করেছিলেন (১৯৫৩)।
- মার্শাল নিরেনবার্গ: জিনেটিক কোড ভেঙেছিলেন (১৯৬১)।
- হ্যারোল্ড ক্লুভার: প্রথম জিন সিকোয়েন্সিং করেছিলেন (১৯৭০)।
- জর্জেস কোহলার এবং সেজার মিলস্টেইন: হাইব্রিডোমা প্রযুক্তি উন্নত করেন, যা একক অ্যান্টিবডি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- হ্যামিলটন স্মিথ এবং ড্যানিয়েল ন্যাথান্স: রেস্ট্রিকশন এনজাইম আবিষ্কার করেন, যা DNA কে কাটার জন্য অপরিহার্য।
- ভের্নার আরবের: জেনেটিক কোড ভেঙেছিলেন, যা DNA কে প্রোটিনে অনুবাদ করার নিয়ম ব্যাখ্যা করে।
বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রটি তুলনামূলকভাবে নতুন, তবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) এবং জাতীয় জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (GEBI) সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণা পরিচালনা করে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণা কৃষি উৎপাদনশীলতা উন্নত করা ও রোগ প্রতিরোধী ফসল তৈরি করা এবং চিকিৎসায় চিকিৎসা উন্নত করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।
উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশী জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার:
- ড. আহমেদ মো. জাফর: তিনি বাংলাদেশের "জিন প্রযুক্তির জনক" হিসেবে পরিচিত। তিনি ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে জিন প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠা করেন এবং জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্ভিদের উন্নত জাত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- ড. কাজী মো. সালাউদ্দিন: তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জৈব সার, রোগ প্রতিরোধী ফসল এবং জৈব-ঔষধের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
- ড. কামাল মো. মজিদ: তিনি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) একজন বিজ্ঞানী এবং জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য কাজ করছেন।
- ড. মোহাম্মদ আবদুল বাকী: জাতীয় জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের (GEBI) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। তিনি বিটি সুপতি তুলসী, ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ধান এবং লবণ সহিষ্ণ ধানের জাত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
- ড. মো. জাহাঙ্গীর কবির: তিনি ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার অ্যাগ্রিকালচার (INA) এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান। তিনি শস্যের উন্নত জাত তৈরির জন্য কোর্যাডিয়েশন ব্রিডিং এবং জিনগত পরিবর্তন প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষণা করছেন।
- ড. ফরিদা আহমেদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক, জিন থেরাপির উপর গবেষণার জন্য বিখ্যাত, থ্যালাসেমিয়া ও সিস্টিক ফাইব্রোসিসের চিকিৎসার জন্য নতুন পদ্ধতি তৈরিতে কাজ করেন।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রক্রিয়া
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং একটি জটিল বহু-স্তরের প্রক্রিয়া যা নিম্নলিখিত ধাপগুলির সমন্বয়ে গঠিত:
জিন নির্বাচন ও সনাক্তকরণ: প্রাথমিক ধাপ জড়িত জিনের সাবধান নির্বাচন এবং সনাক্তকরণ। এটি জটিল ডেটা বিশ্লেষণ, কম্পিউটেশনাল মডেলিং এবং জিনোমিক ডেটাবেসের ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। জিন নির্বাচন প্রক্রিয়া রোগের জন্য দায়ী জিন, কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য প্রদানকারী জিন, অথবা সম্পূর্ণ নতুন কার্যকারিতা প্রদানকারী জিনের উপর নির্ভর করে।
ডিএনএ নিষ্কাশন এবং বিশুদ্ধি: নির্বাচিত জিন ধারণকারী ডিএনএ উৎস জীব থেকে সাবধানতার সাথে নিষ্কাশন করা হয়। উৎস জীব কোষ, টিস্যু, রক্ত অথবা উদ্ভিদের পাতা হতে পারে। ডিএনএ নিষ্কাশন প্রক্রিয়া অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সম্পন্ন করা হয় যাতে ডিএনএ অবনতি এড়ানো যায়।
DNA ক্লোনিং এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি: পরবর্তী ধাপে, নিষ্কাশিত ডিএনএ ক্লোন করা হয়, যার অর্থ হল জিনের অনেকগুলি কপি তৈরি করা হয়। এটি প্লাসমিড নামক একটি ছোট, বৃত্তাকার ডিএনএ অণুর মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় যা "বাহক" হিসেবে কাজ করে। প্লাসমিড-ডিএনএ সংযোজিত জিনকে ব্যাকটেরিয়াল কোষে স্থানান্তর করতে ব্যবহৃত হয়।
জিন সংযোজন এবং পুনর্নবীকরণ: ক্লোন করা জিন এরপর একটি নির্বাচিত বাহক ডিএনএর সাথে সংযুক্ত করা হয়। এটি রেস্ট্রিকশন এনজাইম এবং লাইগেস নামক বিশেষ এনজাইম ব্যবহার করে অর্জন করা হয়। রেস্ট্রিকশন এনজাইম নির্দিষ্ট ডিএনএ অনুক্রমগুলিকে কেটে দেয়, যখন লাইগেস সংযুক্ত ডিএনএ অংশগুলিকে একসাথে লাগায়। লিগেজ এনজাইম নামক আরেক ধরণের এনজাইম ব্যবহার করে, তারা কাটা ডিএনএ টুকরোগুলিকে একসাথে সংযুক্ত করে, নতুন রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ অণু তৈরি করে।
রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রবেশ: রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ তারপরে বাহক জীবে স্থানান্তরিত করা হয়, যা ট্রান্সফরমেশন নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বিভিন্ন ট্রান্সফরমেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যেমন ব্যাকটেরিয়াল ট্রান্সফরমেশন, ভাইরাল ট্রান্সডাকশন এবং পলিইথিলিন গ্লাইকল (PEG)-মধ্যস্থতায় কোষ সংমিশ্রণ।
নির্বাচন: সেই বাহক জীবগুলিকে চিহ্নিত করা হয় যারা সফলভাবে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ গ্রহণ করেছে। নির্বাচনী এজেন্ট ব্যবহার করে, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক বা নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদানের অভাব, বিজ্ঞানীরা কেবলমাত্র সেই জীবগুলিকে টিকে থাকতে এবং বংশবৃদ্ধি করতে দেয় যারা কাঙ্ক্ষিত জিন বহন করে।
মূল্যায়ন ও পরীক্ষা: বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করেন যে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ সঠিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এবং বাহক জীবে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য তৈরি করছে কিনা।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রকারভেদ
জীবের জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়। এর কিছু প্রধান প্রকারভেদ হলো:
- পুনরায় সংমিশ্রণ ডিএনএ প্রযুক্তি (Recombinant DNA Technology): এই প্রযুক্তিতে, বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জীবের DNA থেকে নির্দিষ্ট জিন কেটে বের করে অন্য জীবের DNA-এর সাথে সংযুক্ত করেন। এর ফলে নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জীব তৈরি করা সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইনসুলিন উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়া তৈরি করতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
- জিন থেরাপি (Gene Therapy): এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে, জিনগত ত্রুটিযুক্ত কোষের DNA-তে পরিবর্তন আনা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগের চিকিৎসায় জিন থেরাপি ব্যবহার করা হয়।
- জিনোম সম্পাদনা (Genome Editing): এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে, জীবের DNA-তে সরাসরি পরিবর্তন আনা সম্ভব। CRISPR-Cas9 হল জিনোম সম্পাদনার একটি জনপ্রিয় হাতিয়ার। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে, বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদের পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করতে পারেন, বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারেন।
- ক্লোনিং (Cloning): এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে, একই জিনগত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জীব তৈরি করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ডলি দ্য শিপ ক্লোনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছিল।
- স্টেম সেল থেরাপি (Stem Cell Therapy): এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। স্টেম সেল হল অবিশেষায়িত কোষ যা বিভিন্ন ধরণের কোষে পরিণত হতে পারে।
এছাড়াও, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর আরও অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হচ্ছে এবং জীববিজ্ঞান, চিকিৎসা, কৃষি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষা ব্যবস্থা
বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব অর্জন করছে। জীববিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, এবং ফার্মাসিউটিক্যালসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান প্রয়োগের সাথে সাথে দক্ষ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চাহিদা পূরণের জন্য, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের ডিগ্রি প্রদান করছে।
১৯৯৫ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘BSC in Biotechnology’ প্রোগ্রাম চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বায়োটেকনোলজি-র যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ২০০৩ সালে ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে প্রোগ্রামটি চালু হয়।
স্নাতক স্তরের ডিগ্রি:
- ব্যাচেলর অফ সায়েন্স (B.Sc.) in জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: এই ডিগ্রি 4 বছরের এবং এটি জীববিজ্ঞান, রসায়ন, জিনগত বিজ্ঞান, এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মৌলিক নীতিগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
- ব্যাচেলর অফ টেকনোলজি (B.Tech.) in জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: এই ডিগ্রি 4 বছরের এবং এটি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রযুক্তিগত দিকগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, যার মধ্যে রয়েছে জিন ম্যানিপুলেশন, টিস্যু কালচার এবং বায়োপ্রসেসিং।
স্নাতকোত্তর স্তরের ডিগ্রি:
- মাস্টার অফ সায়েন্স (M.Sc.) in জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: এই ডিগ্রি 2 বছরের এবং এটি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
- মাস্টার অফ ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স (M.Pharm.) in জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: এই ডিগ্রি 2 বছরের এবং এটি ওষুধ তৈরিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রয়োগের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
- মাস্টার অফ ফাইলোসফি (M.Phil.) in জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: এই ডিগ্রি 1.5-2 বছরের এবং এটি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গবেষণার জন্য প্রস্তুতির জন্য।
- ডক্টর অফ ফিলোসফি (Ph.D.) in জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: এই ডিগ্রি 4-6 বছরের এবং এটি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গভীর গবেষণার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
বাংলাদেশের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান যেখানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি অর্জন করা যায়:
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
- বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (BUET)
- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন BRAC University, American International University-Bangladesh (AIUB), ইত্যাদি।
বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্যারিয়ার
জীবপ্রযুক্তির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, যেখানে জীবের জিনগত গঠন পরিবর্তন করে তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়। চিকিৎসা, কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং উন্নয়নশীল জৈবপ্রযুক্তি শিল্পে দক্ষ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য উল্লেখযোগ্য চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার সম্ভাবনা ও বাস্তবতা সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রদান করা জরুরি।
শিক্ষাগত যোগ্যতা:
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে সফল ক্যারিয়ার গড়তে হলে, শিক্ষার্থীদের নিম্নলিখিত শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করা উচিত:
- স্নাতক: জীববিজ্ঞান, রসায়ন, কৃষি, বা ফার্মাসি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি। উচ্চ GPA এবং জিনগত বিষয়ে কোর্স থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
- স্নাতকোত্তর: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, বা আণবিক জীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। গবেষণাগারে কাজের অভিজ্ঞতা এবং প্রাসঙ্গিক প্রকাশনা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
- এম.ফিল. অথবা পিএইচ.ডি.: উচ্চতর গবেষণা ও শিক্ষকতার জন্য। বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি অর্জন এবং উল্লেখযোগ্য গবেষণা প্রকাশনা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
কর্মসংস্থানের সুযোগ:
দক্ষ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বাংলাদেশে বৈচিত্র্যময় কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- গবেষণা প্রতিষ্ঠান: সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষক, প্রকল্প সহযোগী, বা গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে কর্মকর্তা হিসেবে।
- ঔষধ কোম্পানি: ওষুধ ও টিকা আবিষ্কার, উন্নয়ন, এবং উৎপাদনে জড়িত বিভিন্ন পদে।
- জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি: কৃষি, খাদ্য, পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্য উন্নয়ন ও বাজারজাতকরণে।
- বিশ্ববিদ্যালয়: জিনতত্ত্ব, জৈবপ্রযুক্তি, বা সম্পর্কিত বিষয়ে শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে।
বেতন: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের বেতন তাদের অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কর্মক্ষেত্রের উপর নির্ভর করে। সাধারণত, একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারের শুরুর বেতন ৫০,০০০ টাকা থেকে ৮০,০০০ টাকার মধ্যে থাকে। অভিজ্ঞ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা ১,৫০,০০০ টাকা বা তার বেশি বেতন পেতে পারেন।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যবহার
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জীবপ্রযুক্তির একটি শাখা, যেখানে জীবের জিনগত গঠন পরিবর্তন করা হয়। এটি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে রয়েছে:
কৃষি:
- ফসলের উন্নতি: জীবাণুনাশক, কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ, খরা সহিষ্ণুতা, উন্নত পুষ্টিগুণ, এবং বৃদ্ধির হার বৃদ্ধির জন্য ফসলের জিন পরিবর্তন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, Bt সয়াবিন জীবাণুনাশক প্রতিরোধী, এবং স্বর্ণ ধানে ভিটামিন এ উচ্চ মাত্রায় থাকে।
- পশুপালন: দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, এবং দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রাণীর জিন পরিবর্তন করা হয়।
ঔষধ:
- ঔষধ উৎপাদন: ইনসুলিন, হিউম্যান গ্রোথ হরমোন, এবং ভ্যাকসিনের মতো জটিল ঔষধ তৈরি করতে জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীব ব্যবহার করা হয়।
- জিন থেরাপি: জিনগত রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীর কোষে সুস্থ জিন প্রবেশ করানো হয়।
- রোগ নির্ণয়: জিনগত পরীক্ষার মাধ্যমে জিনগত রোগের ঝুঁকি নির্ণয় করা যায়।
শিল্প:
- জৈব জ্বালানি: জীবাণু ব্যবহার করে জৈব জ্বালানি তৈরি করা হয়।
- পরিবেশগত পরিষ্কার: পরিবেশ থেকে বিষাক্ত পদার্থ অপসারণের জন্য জীবাণু ব্যবহার করা হয়।
অন্যান্য:
- মানব জিনোম: মানব জিনোমের মানচিত্র তৈরি এবং জিনগত রোগের কারণ বোঝার জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করা হয়।
- ফরেনসিক বিজ্ঞান: অপরাধীদের সনাক্তকরণের জন্য জিনগত প্রোফাইলিং ব্যবহার করা হয়।
কৃষি খাতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জৈব প্রযুক্তির একটি শাখা, যা জীবের জিনগত গঠন পরিবর্তন করতে ব্যবহৃত হয়। কৃষিক্ষেত্রে, এই প্রযুক্তি উদ্ভিদ ও প্রাণীর নতুন জাত তৈরি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে যা উচ্চ ফলনশীল, রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী এবং পরিবেশগত চাপ সহনশীল।
- উচ্চ ফলন: জিনগতভাবে পরিবর্তিত (জীএম) ফসল উচ্চ ফলন দিতে পারে, যার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায় এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পায়।
- রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধ: জীএম ফসল রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী জিন ধারণ করতে পারে, যার ফলে কীটনাশকের ব্যবহার কমে এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাব হ্রাস পায়।
- পরিবেশগত চাপ সহনশীলতা: জীএম ফসল খরা, লবণাক্ততা এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনের মতো পরিবেশগত চাপ সহ্য করতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে।
- পুষ্টি উন্নতি: জীএম ফসল ভিটামিন, খনিজ এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ করার জন্য তৈরি করা যেতে পারে, যা বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে জনস্বাস্থ্যের উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে।
- জৈব জ্বালানীর উৎপাদন: জীএম ফসল জৈব জ্বালানীর উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, যা জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। কৃষি গবেষণায় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই পর্যন্ত অনেক ট্রান্সজেনিক ফসল আবিষ্কার করা হয়েছে। তার মধ্যে উন্নত প্রজাতির ধান এবং পাট উল্লেখযোগ্য।
লেখকের শেষ কথা
আশা করি আজকের এই আর্টিকেলটিতে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি? বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্যারিয়ার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য কিছুটা হলেও জানাতে পেরেছেন। বাংলাদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব অর্জন করছে। জীববিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, এবং ফার্মাসিউটিক্যালসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান প্রয়োগের সাথে সাথে দক্ষ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এতক্ষণ আমাদের আর্টিকেলের সঙ্গে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। যদি এই ধরনের তথ্য আরো জানতে চান তাহলে নিয়মিত আমাদের ওয়েবসাইট ফলো করতে থাকুন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url